লিসবনে দ্বিতীয় দিন

শুক্রবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, দুপুর ০৩:৩১


পরদিন বেশ সকালেই ঘুম থেকে উঠলাম। এখানে একটু দেরিতেই সকাল হয়, তাই আবার একটু গড়িয়ে নিয়ে হোটেলের কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট সেরে তৈরি হয়ে নিলাম। আমাদের যেতে হবে মিও অ্যারেনায়। যথারীতি রসিও চত্বর থেকে বাসে উঠলাম। অল্প সময়েই পৌঁছে গেলাম মিও অ্যারেনায়। মিও অ্যারেনা বিশাল জায়গাজুড়ে এই কনফারেন্স হল। ১৯৯৮ সালের এক্সপো ৯৮ উপলক্ষে তৈরি এই বিশালাকৃতির কনফারেন্স হলের ধারণক্ষমতা ২০,০০০। পর্তুগাল তো বটেই ইউরোপেরই অন্যতম বড় হল হচ্ছে এই মিও অ্যারেনা। তবে এই লেখা যখন লিখছি ততদিনে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে এল্টিস অ্যারেনা নামে। এক্সপো ৯৮ যখন লিসবনে আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়, তখন সমস্যা দেখা দিল আয়োজনস্থল নিয়ে। লিসবনে সেই অর্থে বড় ধরনের কোনো কনফারেন্স হল ছিল না যেখানে এই ধরনের বিশাল একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যায়। লিসবন কলোসিয়ামে যদিও কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হোত, কিন্তু এ ধরনের বৃহৎ অনুষ্ঠানের জন্য তা মোটেও পর্যাপ্ত ছিল না। বেশ কিছু আউটডোর স্টেডিয়াম থাকলেও বাজে আবহাওয়া বা শীত কিংবা বর্ষায় ইনডোর অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যবস্থা না থাকায় বেশ কয়েক যুগ ধরেই লিসবন বঞ্চিত হচ্ছিল বড় ধরনের কোন কনসার্ট, ইনডোর গেমস বা কনফারেন্স আয়োজন হতে। এসব অসুবিধা দূর করতেই শহরের মেয়রের উঠে পড়ে লাগা। উদ্যোগের পালে হাওয়া লাগিয়ে যুৎসই জায়গাও মিলে যায়। শহরের কোলাহল থেকে সামান্য বাইরে, আবার শহরের সাথে খুব ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্বলিত একটা জায়গা, যা লিসবনের প্রধান রেলস্টেশন, গারো দো ওরিয়েন্টে এর লাগোয়া। তাগোস নদীর পার ঘেষেই নির্মিত হয় এই কনফারেন্স সেন্টার। শুরুতে এর নাম দেয়া হয় প্যাভিলো আটলান্টিকো। ২০১২ সালে ২১২ মিলিয়ন ইউরোতে এই অ্যারেনা বিক্রি করে দেয়া হয় অ্যারেনা আটলান্টিকো নামের কোম্পানিকে। ২০১৩ সালে পর্তুগাল টেলিকম এই অ্যারেনার দায়িত্ব পেয়ে তাদের ব্র্যান্ড মিও এর নামে এই অ্যারেনার নামকরন করে মিও অ্যারেনা। সম্প্রতি ফ্রান্সের টেলিকমিনিকেশন কোম্পানি এল্টিস পর্তুগাল টেলিকম কিনে নিয়ে এই অ্যারেনার নাম পালটে রাখে এল্টিস অ্যারেনা। বিখ্যাত পর্তুগীজ আর্কিটেক্ট রেগিনো ক্রুজের নির্দেশনায় তৈরি এই অ্যারেনা দেখতে অনেকটা ফ্লাইং সসারের মত, কিংবা বলা চলে কচ্ছপের খোলের মতোই। সমুদ্রযাত্রায় পর্তুগিজদের অতীত ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দিতেই কিনা ক্যারাক নামের পঞ্চদশ শতাব্দীর পর্তুগিজ সমুদ্র জাহাজের সাথেও এই অ্যারেনার মিল রাখার চেষ্টা করেছেন আর্কিটেক্ট। এই সেন্টার তৈরির পর থেকেই এখানে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান। গানের কনসার্ট থেকে শুরু করে বিসনেস এক্সপো, মেডিকেল কনফারেন্স সব কিছুর জন্যই প্রথম পছন্দ এই মিউ অ্যারেনা। কনফারেন্স হলে ঢুকে আমাদের গ্রুপ রেজিস্ট্রেশন করে কিট কালেক্ট করে নিলাম। এবারের কনফারেন্সে আমার একটা পোস্টার প্রেসেন্টেশন আছে, তবে সেটা আরো কয়েক দিন পরে। আজ তাই আর সেইদিকে পা না বাড়িয়ে ওরাল প্রেসেন্টেশন হলে ঢুকে পড়লাম। এত বড় আয়োজন, একসাথে বেশ কয়েকটা হলে সেশন চলছে। কোনটা ছেড়ে কোনটায় যাই। তাবৎ দুনিয়ার বাঘা বাঘা প্রফেসররা সব মিলিত হয়েছেন তাদের বিজ্ঞানলব্ধ তথ্য উপাত্ত তুলে ধরার জন্য, সেই সাথে আমাদের মতো জুনিয়রদের কাছে অভিজ্ঞতার ঢালি মেলে ধরার জন্য। বেশ কিছু সেশনে অংশগ্রহণ করে লাঞ্চের সময় হলে লাঞ্চ প্যাকেট নিয়ে একটা টেবিলে বসে কয়েকজন মিলে খেয়ে নিলাম। আজ লাঞ্চের পর আর সেশন নেই, তাই কার্যত আমাদের এখন ছুটি। সুযোগটা কাজে লাগাতে হয়। লিসবন ওশেনারিয়াম হলের খুব কাছেই লিসবন ওশেনারিয়াম, মানে জলের তলার জগত। এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ওশেনারিয়াম। মিউ অ্যারেনা থেকে ওশেনারিয়াম পর্যন্ত ক্যাবল কার রয়েছে। বিখ্যাত আর্কিটেক্ট পিটার চারমেফের নির্দেশনায় তৈরি এই অ্যারেনা তৈরি করা হয় আসলে এক্সপো ৯৮ কে উদ্দেশ্য করেই। এর সেন্ট্রাল ট্যাংক রিপ্রেসেন্ট করে গ্লোবাল ওশানকে আর তাকে ঘিরে থাকা চারটি ছোট ট্যাংক বা একুরিয়ামে রখা হয়েছে আটলান্টিক, প্যাসিফিক, ইন্ডিয়ান আর আর্কটিক ওশানের জলজ জীবনকে। এই ওশেনারিয়ামে ৮০০ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী আর ৭৫০০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ রয়েছে। এই ওশেনারিয়ামের স্বচ্ছ কাচের গ্লাস দিয়ে দেখলে মনে হবে আপনি সহজেই ছুয়ে দিতে পারবেন দুনিয়ার সবচেয়ে ভয়ংকর হাঙ্গর আর বিশাল বিশাল ব্যারাকুডাকে, সাথে দেখতে পাবেন মোরে ঈল আর ডেভিল রেকেও। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা অবধি দর্শক মনোরঞ্জনের জন্য খোলা থাকে এই আনন্দযজ্ঞ। এখান থেকেই ৫ ইউরো দিয়ে আমরা ক্যাবল কারে চড়লাম। ক্যাবল কার থেকে ওশানেরিয়াম আর  অ্যারেনার দৃশ্য খুবই মনোহর। ক্যাবল কার থেকেই দেখলাম ভাস্কো দ্য গামা সেতু। ওশানেরিয়াম এর পাশেই একটা বিশাল শপিং মল। গারে দো ওরিয়েন্টে স্টেশন গারে দো ওরিয়েন্টে স্টেশন বা সংক্ষেপে শুধু ওরিয়েন্টে বললেই যে কেউ আপনাকে চিনিয়ে দিবে লিসবনের সবচেয়ে বড় আর বিখ্যাত স্টেশনকে। এটি একাধারে বাস আর ট্রেন স্টেশন। বিখ্যাত স্প্যানিশ স্থপতি সান্টিয়াগো কালাট্রাভার নির্দেশনায় তৈরি এই স্টেশন থেকে বাস বা ট্রেনে চেপে পর্তুগাল এবং ইউরোপের বিভিন্ন গন্তব্যে আপনি ঘুরে আসতে পারবেন। আর লিসবন মেট্রোর মাধ্যমে সরাসরি এয়ারপোর্ট পর্যন্তও সহযেই পৌছতে পারবেন। বিকালে কনফারেন্স শেষ করে কিছুটা সময় পাশের শপিং মলে কাটিয়ে আবার একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরলাম। কিছুক্ষণ পর শুভ মামা আর ফয়সাল মামা তাদের কাজ শেষ করে আসলে আবার গত দিনের মতো বেড়িয়ে পড়লাম। আজকে সঙ্গী হলো বেলাল ভাই। বেলাল ভাই বয়সে বেশ সিনিয়র। বয়স পঞ্চাস পেরিয়েছে, কিন্তু একসাথে ঘুরতে গিয়ে টের পেলাম, মনের মিল থাকলে বয়স আসলে কোন বাঁধা নয়। গত দিনের মতোই আজ আবার বিভিন্ন গলি পেরিয়ে এগিয়ে চললাম শহরতলীর বুক চিরে। মামার কাছে জানতে পাড়লাম আমাদের আজকের গন্তব্য আলফামা আর বাঙালিপাড়া। আগের দিনের মতোই আবার আমরা সাদা-কালো খোয়া বিছানো পথ ধরে হাঁটতে লাগলাম। রাস্তার দুইধারে বিভিন্ন নামি-দামি ব্র্যান্ডের দোকান। দেখে চোখ ঝলসে উঠলেও দাম দেখে সেই ঝলসানো চোখে বৃষ্টির ধারা নেমে আসে। যাই হোক সযতনে সেই সব দোকান পেড়িয়ে আবার আমরা এসে পৌঁছলাম রসিও চত্বরে। পুরো চত্বর যেন লোকের মেলা। আসলে কাল সাপ্তাহিক বন্ধ, তাই আজ সব যায়গায় লোকের আনাগোনা বেড়েছে। মামা জানালেন এই উৎসবের রেশ চলবে ভোর অবধি। সেই সব পেড়িয়ে রুয়া আগাস্তা ধরে আমরা এগিয়ে চললাম কমার্স স্কয়ারের দিকে। কমার্স স্কয়ার থেকে বাম দিকে একটা গলিপথ পেরিয়ে এবার একটু চড়াইতে উঠতে হলো। একটু এগিয়ে গিয়ে পেলাম ১৪৯৫ সালে তৈরি সেন্ট এন্টোনিও চার্চ, এর সাথেই রয়েছে সেন্ট এন্টোনিও মিউজিয়াম। চার্চ পেড়িয়ে একটু সামনে বাড়তেই হুস হুস আওয়াজ তুলে একটা ট্রাম পেড়িয়ে গেল। হলুদ রঙের ট্রাম। মামা জানালেন এটা ট্রাম ২৮, লিসবনের হেরিটেজ ট্রাম। ট্রামে চড়ে ইতিহাসের পাতায় বিশ্বের অনেক শহরেরই বিশেষ আকর্ষণ থাকে৷ পর্তুগালের রাজধানী লিসবনের তেমনি একটি মুখ্য আকর্ষন হচ্ছে এই প্রাচীন ট্রাম যা শহরের আত্মার প্রতীক বলে বিবেচনা করা হয়৷ সেই ট্রামে চেপে আপনি সহজেই ঘুরে দেখতে পারেন লিসবনের প্রধান দ্রষ্টব্যগুলো৷ ট্রাম ২৮ কে বিবেচনা করা হয় লিসবনের আইকন হিসেবে। এই ট্রামগুলি শুধু পর্যটক আকর্ষণ নয় বরং শহরের পরিবহন ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর বাইরেও আরো বিভিন্ন ধরনের ট্রাম রয়েছে যেগুলিতে চড়ে আপনি শহর ঘুরে নিতে পারেন। এছাড়াও হফ-অন-হফ-অফ তো রয়েছেই। হপ-অন-হফ-অফ ট্রামগুলো মূলত ট্যুরিস্টদের উদ্দেশে করা, যা আপনাকে লিসবনের সেরা দর্শনীয় স্থানগুলিতে একটি বৃত্তাকার ট্রাম রুটের মাধ্যমে ঘুরিয়ে দেখাতে পারে। একবার পাশ কিনে আপনি ২৪ ঘন্টার জন্য এই ট্রাম আনলিমিটেড ব্যবহার করতে পারবেন, মানে আপনি যে কোন স্টেশনে নেমে দর্শন সেরে আবার পরের ট্রামে উঠে পরবর্তী গন্তব্যে যেতে পারবেন। ট্রামটিতে একটি অডিও গাইড রয়েছে; যা আপনাকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে সহায়তা করবে। ট্রাম ২8 নামের এই 'কম্যুটার' ট্রাম লিসবনের সেরা আকর্ষণের একটি। মাত্র ৫ টিকিটের মাধ্যমে ট্রাম ২8 আপনাকে লিসবনের সেরা দর্শনীয় স্থানগুলোতে নিয়ে যাবে।৩ এর কম বয়সীদের জন্য ট্রামের টিকিট লাগে না, আর আপনার যদি লিবসো কার্ড থাকে তাহলে আপনি বিনামূল্যে এই সেবা উপভোগ করতে পারবেন। আমাদের যেহেতু ডে পাস ছিল তাই আমরাও সুযোগটা কাজে লাগিয়েছিলাম। এই ট্রামে করেই দেখে নিতে পারেন Bairro Alto, Chiado এবং ক্যাথেড্রাল। এই ট্রাম আলফামা পর্যন্ত উঠতে পারে যেখানের শেষ স্টপ পর্যন্ত যেতে পারেন বা সেন্ট জর্জ কাসেলের কাছাকাছি যেতে পারেন। লিসবন শহরের বিখ্যাত ২৮ নম্বর ট্রামের প্রায় সাত কিলোমিটার গতিপথ চড়াই-উতরাইয়ে ভরা৷ একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে এই নড়বড়ে ইলেকট্রিক ট্রাম পর্তুগালের রাজধানীর সেরা আকর্ষণগুলোর পাশ দিয়ে যাত্রীদের নিয়ে যাচ্ছে৷ ট্রামের লাইন মাত্র ৯০০ মিলিমিটার চওড়া৷ মার্তি মুনিশ চত্বর থেকে এই ট্রাম টিলার উপর সাঁও ভিসেন্তি দি ফোরা মনাস্ট্রি পর্যন্ত যাত্রীদের নিয়ে যায়৷ তাতে এখনো প্রাচীন কাঠের বেঞ্চে বসার সুযোগ রয়েছে৷ শহরের পুরানো আলফামা পাড়ার মধ্য দিয়ে ট্রাম চলে৷ আগে রক্ষীরা সেখানে যান নিয়ন্ত্রণ করলেও এখন ট্রাফিক লাইট সেই কাজ করে৷ খালু এ প্রসঙ্গে মামা মনে করিয়ে দেন, এখান থেকে একটিমাত্র ট্র্যাক রয়েছে৷ অন্য ট্রাম বা গাড়ি উলটো দিক থেকে আসতে পারে বলে খুব সাবধান থাকতে হয়৷ জানালা দিয়ে হাত বাড়ালেই এখানে ঘরবাড়ি ছোঁয়া যায়৷ আলফামা লিসবনের প্রাচীনতম অংশের মধ্যে পড়ে৷ সেখানকার উঁচুনিচু পথ ও সরু অলিগলির কথা ভেবেই এই ট্রাম তৈরি করা হয়েছিল৷ শহরের নানা ভিউ পয়েন্ট থেকে পর্যটকরা এই ট্রামে ওঠানামা করেন৷ আপনি চাইলে যে কোন ভিউ পয়েন্ট থেকে তাগুস নদীর মোহনার মোহনীয় দৃশ্য তারা উপভোগ করতে পারেন৷ ‘কালসাদা দে সাঁও ফ্রানসিস্কো’ নামের রাস্তায় ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ খাড়া পথ বেয়ে উঠতে হয়৷ বিশ্বের অন্য কোনো ট্রাম সেটা পারে না৷ ট্রামের যাত্রাপথে একের পর এক দ্রষ্টব্য রয়েছে৷ সান্টা লুসিয়া গির্জার বাইরে রং করা চিনামাটির টাইলস শোভা পাচ্ছে৷ লিসবনের বর্ণাঢ্য ইতিহাস তাতে ফুটে উঠেছে৷ পরের স্টপ ‘সে পাত্রিয়ার্কাল’৷ শহরের সবচেয়ে প্রাচীন গির্জার পাশ দিয়ে খাড়া পথ নেমে গেছে৷ ট্রাম চালানোর কায়দা সম্পর্কে যা জানলাম, ট্রামের একাধিক ব্রেক রয়েছে৷ একটি অকেজো হলে অন্যটি ট্রাম থামাতে পারবে৷ চালাতে গেলে হাতল সামনে ঘোরাতে হয়৷ টেনে ধরলে চাকা পিছনদিকে ঘুরে ব্রেক করে৷ এটা নিউম্যাটিক ব্রেক, এটা ম্যাগনেটিক এবং অন্যটি হ্যান্ড ব্রেক। ট্রাম যাত্রার শেষপর্যায়ে আপনি ঘুরে দেখতে পারেন সংসদ ভবন ও বাসিলিকা দা ইশত্রেলা৷ প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ৩৮টি স্টপ পেরিয়ে শহর ঘোরার অভিজ্ঞতা আপনার ভ্রমণ ঝুলিকে সমৃদ্ধ করবে একথা গ্যরন্টি দিয়ে বলা যায়। আমাদের হাতে যেহেতু এখনো অনেকগুলো দিন রয়েছে তাই এ যাত্রা আর ট্রামে না চড়ে আমরা পাহাড়ের আরেকটু উপরের দিকে উঠতে লাগলাম। আমাদের খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না, কিন্তু চিন্তায় ছিলাম বেলাল ভাইকে নিয়ে। মাঝে মাঝে এই জন্যই বিরতি নিচ্ছিলাম। আমারো সুবিধা হলো তাতে। থেমে থেমে ছবি তুলতে পারছিলাম। এখন আমরা যে জায়গায় দাঁড়িয়ে এই জায়গার নাম আলফামা। আলফামা আলফামা হলো লিসবনের অন্যতম প্রাচীন ও পুরাতন এলাকা যেটি ১৭৫৩ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের ও জলোচ্ছ্বাসের পরেও অক্ষত অবস্থায় টিকে রয়েছে। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক এখানে ভিড় জমায় সরু রাস্তা ও প্রাচীন জনপদ দেখার উদ্দেশ্যে। লিসবনের সবচেয়ে পুরনো জেলা তার পুরনো কঙ্কালসার সড়ক এবং একই ধরনের কাঠামো নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে পর্যটক মনোরঞ্জনের জন্য। আলফামা বিখ্যাত তার কিছু সেরা মিরাদুরো বা ভিউ পয়েন্টের জন্য, যার মধ্যে অয়তম সেন্ট জর্জ কাসল, যেটি আসলে একটি মধ্যযুগীয় মুরিশ ক্যাসল যা লিসবন সর্বোচ্চ পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। রসিও থেকে হেঁটে হেঁটেই আপনি এই ক্যাসলে পৌঁছতে পারেন আর যদি হাটা এভোয়েড করতে চান তাহলে সোজা উঠে পরুন ট্রাম ২৮-এ। পথেই পড়বে লিসবন ক্যাথেড্রাল, চাইলে সেখানেও একটু ঢুঁ মেরে আসতে পারেন। আলফামাকে বলা হয়ে থাকে লিসবনের সিগনেচার মিউসিক ফাদোর জন্মস্থান। হাতে সময় থাকলে একটা সন্ধ্যা কাটাতে পারেন এখানকার কোন রেস্টুরেন্টে বসে ফাদো উপভোগের সাথে সাথে সি ফুড দিয়ে। পাহাড়ের বেশ অনেকটা উপরে উঠে এসেছি। সবাই কম বেশি ক্লান্ত। সামনেই একটা ভিউ পয়েন্ট। রেলিং দিয়ে ঘেরা একটা ব্যালকনির মতো জায়গা সাথে কয়েকটা পাথরের বেঞ্চ বসানো। আমরা সেই বেঞ্চেই বসলাম। উপর থেকে চমৎকার দৃশ্য মন ভরিয়ে দিল। নিচে সব একই ধরনের লাল টালির সাদা সাদা বাড়ি, রাতের লাইটের আলোয় কেমন যেন এক অপার্থিব পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। আর তাগুস নদীর ঠাণ্ডা বাতাস শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছিল। সবমিলিয়ে বেশ উপভোগ্য একটা আবহ। এখান থেকেই বসে বসে শুনতে পেলাম লিসবন ক্যাথেড্রালের ঘণ্টার শব্দ। এই নিস্তব্ধ পরিবেশে ঘণ্টার ঢং ঢং শব্দ আর আশে পাশের বিল্ডিংয় বাড়ি খেয়ে ফিরে আসা ইকো অনুরিত হচ্ছিল চারপাশজুড়ে। এই সৌন্দর্য আর পারিপার্শ্বিকতা কেবল অনুভবই করা যায়, না তাকে ফ্রেমবন্দি করা যায়, না তাকে লেখার অক্ষরে বন্দি করা যায়। এখানেই কিছুদিন আগে শুটিং হয়ে গেছে বলিউডের শাহেনশাহ খ্যাত শাহরুখ খান ও আনুশকা শর্মা অভিনীত ছবি “যাব হ্যারি মেট সেজেল” এর। পাথরের বেঞ্চে বসে বসে দেখছিলাম আরও একটু উচুতে সেন্ট জর্জ ক্যাসেলের আলোকমালা। মনের ক্যনাভাসে আঁকা পরছিল কত ছবি, না জানি কেমন ছিল এখানকার মানুষদের জীবনযাত্রা। তাদের লাইফস্টাইল আর আজকের লাইফস্টাইলের না জানি কত তফাত, তাদের মন মানসিকতার সাথেও নিশ্চয়ই আজকের দিনের মানুষের মন মানসিকতার অনেক বৈপরিত্য। আমাকে এই রকম ভাবুক দৃষ্টিতে ক্যাসেলের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফয়সাল ভাই জিগ্যেস করলেন “কি মামা যাবেন নাকি ক্যাসেলে”। আমার খুব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সাথে বেলাল ভাই থাকায় এ যাত্রা আর সেই রিস্ক নিলাম না। বেচারা এমনিতেই যথেষ্ট উপরে উঠেছে, এর বেশি উঠা উনার জন্য রিস্কি হয়ে যাবে। তাই ভেবে চিনতে না করে দিলাম। তবে মামার কাছ থেকে এ ক্যাসেল সম্পর্কে খুঁটিনাটি জেনে নিলাম। ক্যাসেলো দে সাও জর্জি লিসবনের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এ রাজপ্রাসাদটি পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। রসিও স্কোয়ার থেকে উপরের দিকে তাকালেই দেখা মেলে এই অনিন্দ্য সুন্দর প্রাসাদের। পাহাড়ের পাদদেশে আলফামার পাশে অবস্থিত এই ক্যাসেল থেকে লিসবনের ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ পাওয়া যায়। টাগুস নদীর সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি সামান্য দূরে চোখ ফেললে আটলান্টিকের নীল জলরাশির দেখা মেলে। ১৯৪৭ সালের আগপর্যন্ত মুরিসরা এখান থেকে খ্রিস্টান বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করত কিন্তু ওই বছর Afonso Henriques-এর নেতৃত্বে এই প্রাসাদ দখল হয়ে যায়। এর মধ্যে অবস্থিত জাদুঘর এবং প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন, সুউচ্চ দেয়াল ও পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নিমেষেই যে কারও মন ভালো করে দিতে পারে। ইতোমধ্যে রাত বেশ গভীর হয়েছে, এবার ফেরার পালা। কাল আবার আমাদের গ্রুপের সাথে সিটি ট্যুরে বের হওয়ার কথা। প্ল্যানে আছে বেলেম এরিয়ার বিখ্যাত বেলেম টাওয়ার, ডিসকভারি মনুমেন্ট আর জেরোনিমাস মনেস্ট্রি ঘুরে দেখার। মামা সাবধান করে দিলেন- অনেক হাঁটতে হবে, এই বলে আর অবশ্যই শু এভোয়েড করে কেডস ব্যবহারের পরামর্শ দিলেন। মামার সেদিনের সেই পরামর্শ এখনো অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলি। ইউরোপের অধিকাংশ শহরেই মুখ্য দ্রষ্টব্য স্থান হেঁটেই ঘুরতে হয়, তাই ভালো কেডস না থাকলে পা ফোস্কা পড়ে পরের দিনের ঘোরাঘুরির বারোটা বাজিয়ে দিতে পারে। লেখক: আশরাফ উদ্দিন আহমেদ (শাকিল), চিকিৎসক, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল। রাজনীতি/হেএস

এমএসি/আরএইচ

এই সপ্তাহের পাঠকপ্রিয়

Link copied