অনুপ্রবেশকারী আবারও নৌকা প্রতীক পেতে দৌঁড়ঝাপ!

বিশেষ প্রতিনিধি

শুক্রবার, ২২ অক্টোবর ২০২১, দুপুর ১১:৪৯


শোনা যায় দীর্ঘদিন সৌদি আরবে চাকুরি শেষে দেশে এসে ২০১৬ সালের কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর থানার ১৪ নং আড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে নৌকা প্রতীক বাগিয়ে নেন বিএনপি পরিবারের সদস্য সাঈদ আনছারি বিপ্লব। আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের অবাক করে দিয়ে এক অদৃশ্য ইশারায় বিপ্লব  নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন পাওয়ার ঘটনায় সেই সময় আড়িয়া ইউনিয়নসহ দৌলতপুর উপজেলা জুড়ে আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে।

২০২১ সালের নির্বাচনে এবারও ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি, সেক্রেটারি, থানা আওয়ামীলীগের ত্রান ও সমাজ কল্যান সম্পাদক, প্রচার সম্পাদকসহ অন্তত সাতজন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের পাশকাটিয়ে ১৪ নং আড়িয়া ইউনিয়নে ওই বিপ্লবের হাতেই নৌকা তুলে দিতে জেলা ও থানার কয়েকজন সুযোগ সন্ধানী নেতা জোর তদবিরে নেমেছেন।  ঢাকাতে অবস্থান করে ওই সব নেতারা বিপ্লবকে নৌকা পাইয়ে দিতে মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। শোনা যাচ্ছে এরইমধ্যে প্রার্থী বিপ্লব, তাঁর ছোটভাই এক সময়কার ছাত্রশিবির নেতা তাশফিন আব্দুল্লাহ জব্বার ও ওই সব নেতারা কয়েকজন মিলে কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতাদের সঙ্গে দেখাও করেছেন। এই দলটি বিপ্লব সম্পর্কে ইতিবাচক ইমেজ কেন্দ্রীয় নেতার সামনে তুৃলে ধরে নৌকা প্রতীক আদায়ের চেষ্টা অব্যহৃত রেখেছেন।

আড়িয়া ইউনিয়নের জনগন বলছেন,  দৌলতপুর উপজেলার সব দলেরই রাজনীতি সচেতন নেতাকর্মীরা জানেন বিপ্লব বিএনপি পরিবারের সদস্য।

ইউনিয়ন ঘুরে আওয়ামীলীগ ও বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে  জানা গেছে দৌলতপুর উপজেলার ১৪ নং আড়িয়া ইউনিয়ন বিএনপির বর্তমান কমিটির ১ নম্বর সম্মানিত সদস্য  জনাব আলহাজ আবুল কাসেম বিশ্বাসের ছেলে এই সাঈদ  আনছারী বিপ্লব। যদিও কয়েকবছর আগে আবুল কাসেম মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু কমিটি এখনও বহাল।


বিপ্লবের আপন ছোট ভাই তাশফিন আবদুল্লাহ জব্বার ছাত্রশিবিরের সক্রীয় সদস্য ছিলেন। যিনি ২০১৩ সালের হেফাজত ইসলামের মতিঝিলের  ঘটনায় সক্রীয় ছিলেন এবং তার ফেসবুক পেজে হেফাজতের পক্ষে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালিয়ে ছিলেন। তবে পরবর্তীতে দৌলতপুরের পাশ্ববর্তী উপজেলা আওয়ামীলীগের এক নেতার সহযোগিতায় সরাসরি জেলা ছাত্রলীগের কমিটিতে পদ পেয়ে যান তাশফিন। সেই সময় স্থানীয় ও জাতীয় পত্র পত্রিকায় এ নিয়ে ব্যাপক লেখালেখিও হয়। (সমস্ত প্রমানিদি এই রির্পোটারের হাতে আছে)

এ ছাড়াও বিপ্লবের আপন চাচাতো বড় ভাই আবদুস সাত্তার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কুখ্যাত রাজাকার শাহ আজিজের এপিএস (রাজনৈতিক) ছিলেন। দৌলতপুর আসনের বর্তমান সংসদ সদস্যে ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতির সঙ্গেও বিপ্লব ও তার ছোট ভাই তাশফিনের (জব্বার) দারুণ দহরম মহরম আছে। জানা যায়, এমপি মহাদয় এলাকাতে গেলে সারাক্ষণই সফর সঙ্গী থাকেন এই দুই ভাই।

এবারও নৌকা প্রতীক দেওয়ার জন্য সুকৌশলে সদ্য ঘোষিত ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের দৌলতপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের কমিটিতে সদস্য পদ দিয়ে অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে বিপ্লবকে।

বিপ্লব ও তার ছোট ভাইয়ের  ব্যাপারে ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের নেতা কর্মীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। এমপি মহোদয়ের কাছের মানুষ হওয়াতে অনেকে বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে চান না।  নাম প্রকাশ করা হবে না, এই শর্তে ইউনিয়নের বড় গাংদিয়া গ্রামের এক আওয়ামীলীগ কর্মী জানান বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই প্রায় চল্লিশ বছর আওয়ামীগের সমর্থক তিনি।  বলেন, 'শুধু বিপ্লবের পরিবার না, দুয়েকজন ছাড়া তাদের পুরো বংশই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। দুয়েকজন জামাত শিবিরও আছে।  দৌলতপুরের বিএনপি নেতা ও সাবেক এমপি বাচ্চু মোল্লার সঙ্গে কথা বললে বিপ্লবরা কোন দলের লোক সব পরিস্কার হয়ে যাবে। এখন আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় তাই তাদের কেউ কেউ ভোল পাল্টেছে। তবে আমি লিখে দিতে পারি কোনোদিন যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসে দেখবেন সবার আগে ধানের শিষ হাতে নিয়ে ওই বিপ্লবরায় বিএনপির মিছিলের আগে আগে থাকবেন।,

এই আওয়ামীলীগের কর্মী ক্ষোভের সুরে আরও বলেন, 'যারা দলের দুর্দিনে কষ্ট করেছেন, বিএনপির হাতে মার খেয়েছেন, গ্রেফতার হয়েছেন, জেল খেটেছে, তাদের কথা নেতারা ভাবেন না। দলের ত্যাগী কর্মীরা কমিটিতেও স্থান পাচ্ছেন না, অথচ এমপিসহ উপজেলার কোনো কোনো নেতা বিএনপি জামাতকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াচ্ছেন, কমিটিতে তাদের পদ দিচ্ছেন।  এই বিপ্লবের মত অনুপ্রবেশকারীকে
একবার নৌকা প্রতীক দিয়েছে, আবারও দেওয়ার তদবির করে যাচ্ছেন নেতারা। সত্যকথা কী, দল ক্ষমতার বাইরে না যাওয়া পর্যন্ত এই সব স্বার্থবাদী নেতাদের শিক্ষা হবে না। অবশ্যই ওইসব নেতাদের কিছুই হবে না। কারণ দল বিপদে পড়লে তারা ঢাকায় বসে থাকবেন। এলাকায় আসবেন না। আমরা এখনও কষ্টে আছি, তখনও মার খাবো।"


আওয়ামীলীগে নিজেকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে  অস্বীকার করেন সাঈদ আনসারি বিপ্লব। তিনি বলেন, 'আমি গতবারও নৌকা  প্রতীক পেয়েছি। তা ছাড়া আমি বর্তমান থানা আওয়ামীলীগের সদস্য।'

কতদিন আগে এই কমিটি গঠিত হয়েছে?? জানতে চাইলে বিপ্লব বলেন, ' আগেই কমিটি হয়েছে, তবে প্রকাশ হয়েছে  ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। অর্থ্যাৎ গত মাসে।'

জানা গেছে, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের দলীয় হাইকমান্ডের মতে ২০০৮ সালের পর বিভিন্ন কৌসুলে  অন্যদল থেকে যারা আওয়ামীলীগে ঢুকেছেন, তারা অনুপ্রবেশকারী।

দীর্ঘদিন ধরে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা অন্যদল থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীদের দল থেকে বের করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার কথা বারবার বলে আসছেন। দলের সাধারণ সম্পাদকও অনুপ্রবেশকারীদের নৌকা প্রতীক দেবেন না বলে বারবার কোঠর হুশিয়ারী দিচ্ছেন। অথচ বিপ্লবের মত বিএনপি পরিবারের সদস্যকে নৌকা প্রতীক দিতে জেলা ও উপজেলার নেতারা নাম পাঠিয়ে সুপারিশ করাতে হতাশা প্রকাশ করলে একই ইউনিয়নের (১৪ নং আড়িয়া) চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ও থানা আওয়ামীলীগের ত্রান ও সমাজ কল্যান সস্পাদক মো: স্বপন আলী। তিনি বলেন, 'থানা ও জেলা কমিটির নেতারা বিপ্লবের নাম ঢাকাতে পাঠিয়েছেন, আমার আর কী বলার আছে। নেতারাই ভালো বলতে পারবেন। বিপ্লব তো বিএনপি পরিবারের। তবে গেল সেপ্টেম্বর মাসে গঠিত থানা কমিটিতে বিপ্লবকে আওয়ামীলীগের সদস্য করা হয়েছে।

এই চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী আওয়ামীলীগ নেতা আরও বলেন,' বিপ্লবের বাবা ইউনিয়নের বর্তমান যে কমিটি আছে, সেই কমিটির এখনো ১ নম্বর সম্মানিত সদস্য। তার আপন চাচাতো বড় ভাই এক সময়কার রাজাকার প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমানের রাজনৈতিক এপিএস ছিলেন। তারপরেও সিনিয়র নেতারা তাকে আওয়ামীলীগের প্রার্থী করেছেন। আমরা জুনিয়র হিসেবে কিছু বলতে পারি না।"

দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামীলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তসলিম উদ্দীন। বর্তমান ১৪ নং আড়িয়া ইউনিয়নের আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক। এবারের এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী তিনি।

তসলিম জানালেন, বিপ্লব বিএনপি পরিবারের লোক। গতবারও তাকে নৌকা প্রতীক দেওয়া হয়েছে। বিএনপি থেকে অনুপ্রবেশকারী সে। তিনি বলেন, 'আমরা চাই বিএনপি পরিবারের সদস্য এই অনুপ্রবেশকারীকে যেন নৌকা প্রতীক না দেওয়া হয়। এই ইউনিয়নে খোদ আওয়ামীলীগ যারা করেন, যারা প্রার্থী হয়েছেন তাঁদের মধ্য থেকে যেন নৌকা প্রতীক দেওয়া হয়। '

তিনি মনে করেন, কেন্দ্র থেকে এবার যাচাই বাছাই করেই নমিনেশন দেওয়া হচ্ছে। শুনেছি নমিনেশন বোর্ড এবার খুব সচেতন। প্রার্থীদের সব তথ্য নিয়েই মনোনয়ন দেবেন।'

এ ব্যাপারে দৌলতপুর উপজেলা আওয়ামীলীগীর ১ নং সিনিয়র সহ-সভাপতি ও এই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য রেজাউল হক চৌধুরী বিষয়টি নিয়ে বিরক্ত। দ্বায়ভার নিতে চান না।  দ্বায়ভার দিতে চান বর্তমান এমপি সরোয়ার জাহান বাদশার ওপর। এই সাবেক এমপির কথা, শুধু আড়িয়া ইউনিয়নে বিপ্লবের নাম না, উপজেলার ফিলিপনগর ইউনিয়নের নইমুদ্দীন সেন্টু, প্রাগপুর ইউনিয়নের গেদু মোল্লা, হোগল বাড়িয়া ইউনিয়নের হুমায়ুন কবির। এরা সবাই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। অথচ নৌকা প্রতীক পেতে তাদের নাম কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, 'বর্তমান এমপিই এসব নাম কেন্দ্রে পাঠাতে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছেন।

আমাদের দলের নেত্রী অনুপ্রবেশকারীদের দল থেকে বের করে দিতে বলছেন কিন্তু আমাদের কেউ কেউ তাদের দলে ভেড়াচ্ছেন। ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে অনুপ্রবেশকারীদের হাতে নৌকা প্রতীক তুলে দিতে তাদের নাম কেন্দ্রে পাঠাচ্ছেন। অপমান, লজ্জায় ত্যাগী নেতারা এক সময় দূরে সরে গেলে তো দলই থাকবে না।'


এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান এমপি সরোয়ার জাহান বাদশার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।

তবে তাঁর একান্ত সচিব জিয়াউল কবির সুমন বলেন, 'যাদেরকে অনুপ্রবেশকারী বলা হচ্ছে, তারা আদৌ অনুপ্রবেশকারী কি না, তা আমার জানা নেই। তবে আমার জানা মতে এদের কারো কারো নাম কেন্দ্রে পাঠানো হয়নি।'

এমএসি/আরএইচ

এই সপ্তাহের পাঠকপ্রিয়

Link copied