শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও আওয়ামী লীগ

প্রিন্স সদরুজ্জামান চৌধুরী

মঙ্গলবার, ১৭ মে ২০২২, সকাল ০৫:৫১


 ১৯৮১ সালের ১৩ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হলো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল । কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হলো । ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সময় ভাগ্যক্রমে বিদেশে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা তখন নির্বাসিত জীবন যাপন করছিলেন দিল্লিতে । সভাপতি পদ গ্রহণে শেখ হাসিনাকে রাজি করানো এবং দেশে ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগের অংশ হিসেবে সেসময়ে দিল্লিতে একাধিক বৈঠকও করেছিলেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সময়ের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ । বেশ কয়েকদফা বৈঠকের পর নেত্রী দলের দায়িত্ব নিতে রাজি হলেন এবং দেশে ফেরার সিন্ধান্ত নিলেন ।

১৯৮১ সালের ১৭ মে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দেশে ফিরলেন । ১৯৭৫ এর মর্মান্তিক ঘটনার পর দীর্ঘ ৬ বছর নির্বাসন শেষে দেশের মাটিতে পা রাখেন বঙ্গবন্ধু কন্যা । ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিমানবন্দরে যেভাবে অবতরণ করেছিলেন, ঠিক সেভাবেই । ১০ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধুর অবতরণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক প্রজাতন্ত্রটি দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছিল । আর ১৭ মে শেখ হাসিনার ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণের মধ্য দিয়ে তা পুনঃস্থাপিত হওয়ার যাত্রার শুভসূচনা হলো ।

শেখ হাসিনাকে পেয়ে বাঙালি তার ‘বাঙালিত্ব’ ও ‘বাংলাদেশকে’ ফিরে পাওয়ার আশায় বুক বাঁধলো । আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হলো ‘জয় বাংলা,জয় বঙ্গবন্ধু, স্লোগানে । গগনবিদারী স্লোগানের মধ্যে বেরিয়ে আসেন সাদা রংয়ের ওপর কালো ডোরাকাটা তাঁতের মোটা শাড়ি পরা প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনা । তিনি তখন কাঁদছিলেন, তার কান্না দেখে প্রকৃতিও যেনো কাঁদতে লাগলো, জয়বাংলা রণধ্বনীর সাথে তাল মেলালো আকাশের গর্জন । তিনি দেশ পা রেখেই বললেন, 'বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তি সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি এসেছি, আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি, আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই ।’

নেত্রীর আগমনে তখন গণজোয়ার নিয়ে আসে সারাদেশে । হতাশাগ্রস্ত আওয়ামী লীগ কর্মীরা সাহস পায়, শক্তি পায়, এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা পায় । নিজেদেরকে সুসংগঠিত করতে শুরু করে । বিপন্ন যে জাতি দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের সব অর্জন হারাতে বসেছিলো, তাদের মনে আবারও হারানো মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ফিরে পাওয়ার আশা ফিরে আসে । মানুষের চোখে মুখে ফিরে আসে স্বপ্ন, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের স্বপ্ন, যে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । শুরু হলো শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার আন্দোলনের পথ চলা ।

দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের দৃঢ় অঙ্গীকার করলেন । বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জাতীয় তার নেতা হত্যার বিচার ও স্বৈরতন্ত্রের চির অবসান ঘটিয়ে জনগণের হৃত গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সার্বভৌম সংসদীয় পদ্ধতির শাসন ও সরকার প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা । একটি কঠিন পরিস্থিতে দায়িত্ব নিয়ে দল সুসংগঠিত করে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা মোটেও সহজ কাজ ছিলো না । কিন্তু এই অসাধ্যকেও সাধ্য করেছিলেন তিনি । তার গতিশীল নেতৃত্বেই আজকের সকল অর্জন সম্ভব হয়েছে ।

দেশে ফেরার পর থেকে শেখ হাসিনা টানা চার দশক ধরে সফলতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন এদেশের স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারি, প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে । সেই সঙ্গে তার যোগ্য নেতৃত্বে চার বার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া দলটি । বর্তমান মেয়াদসহ ১৭ বছর দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শেখ হাসিনা ।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় মেয়ে শেখ হাসিনাকে এই দীর্ঘ সময় দলের প্রধানের দায়িত্বে থেকে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে । নানা চড়াই-উৎড়াই, কারাবরণ, মৃত্যুর মুখোমুখী হওয়াসহ অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে তিনি আওয়ামী লীগকে আজকের অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছেন । শেখ হাসিনার সফল নেতৃত্বের ফলেই আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ থেকে চার বার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার সুযোগ পেয়েছে এবং বর্তমানে টানা তৃতীয়বার ক্ষমতাসীন । তাঁরই নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের এই সময়ের শাসন আমলেই দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের নতুন মাত্রা সূচিত হয়েছে । শেখ হাসিনার শাসনামলেই গত বছর বাংলাদেশ স্বল্পন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে । তার হাত ধরেই বাংলাদেশ ডিজিটাল দেশে পরিণত হয়েছে ।

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, এমজিডি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গসমতা, কৃষি দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলে পোশাক শিল্প, ঔষধ শিল্প, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক বৃদ্ধি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টি ও পরিশ্রমের ফসল । এছাড়া পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ, দেশের মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে বা হচ্ছে তার দুরদর্শী নেতৃত্বের কারনেই ।


১৯৮১ সালের ১৭ মে তার দুঃসাহসী সিদ্ধান্তের কারণেই আওয়ামী লীগ আজ দল হিসেবে অনেক বেশি শক্তিশালী ।

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত মোট ১৭ বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন এর আগে আর কেউ করেননি । এর বাইরে ১১ বছরেরও বেশি সময় বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন জাতীয় সংসদে । আওয়ামী লীগ আজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সামরিক শাষনের স্মৃতিকে পেছনে ফেলে দেশকে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখিয়েছে । তার দেশে ফেরার সিন্ধান্ত দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে, জাতি হিসেবে বাঙালিকে এবং দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে এক ভিন্ন উচ্চতায় ।

একসময়ে বঙ্গবন্ধুর নামে যে বাংলাদেশকে চিনতো বিশ্বের মানুষ, আজ সে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল। স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের এই দিনে সবার প্রত্যাশা হোক 'শেখ হাসিনা দীর্ঘজীবি হোন'।

এমএসি/আরএইচ

এই সপ্তাহের পাঠকপ্রিয়

Link copied